কমলাকৃতির সবুজ-হলুদ রঙের এ পেয়ারা দেখলেই বুঝা যায় চন্দনাইশের পেয়ারা। ভেতরে সাদা, হলুদ, লাল। তুলনামূলক বিচি কম, মিষ্টি বেশি এ পেয়ারা। চারা রোপণ থেকে ফল আহরণ পর্যন্ত তেমন একটা রাসায়নিক সার কিংবা কীটনাশক ব্যবহার হয় না বলে স্বাস্থ্যের জন্য তা নিরাপদ।
জানা গেছে, এ অঞ্চলে প্রচুর বৃষ্টিপাত হওয়ায় পাহাড় ও পাহাড়ের পাদদেশে নতুন পলি জমার কারণে এখানকার মাটি খুব উর্বর হয়। এর ফলে পেয়ারা চারা রোপণ থেকে শুরু করে গাছ বড় হওয়ার পর পেয়ারা ফলন আসা ও পরিপক্ব পেয়ারা সংগ্রহ করা পর্যন্ত গাছের গোড়ায় রাসায়নিক সার প্রয়োগ ও গাছে কোনো প্রকার কীটনাশক ছিটানো প্রয়োজন হয় না বাগান মালিক ও চাষিদের। এ কারণে এই পেয়ারাকে স্বাস্থ্যসম্মত বা (অর্গানিক) পেয়ারা বলে। তাছাড়া চাষিরা ডাঁটা ও পাতাসহ পেয়ারা সংগ্রহ করে এ কারণে ফরমালিন ও রাসায়নিক দ্রব্য মেশানো ছাড়াই চার-পাঁচ দিন অনায়াসে এ পেয়ারা সংরক্ষণ করা যায়।
চন্দনাইশের কাঞ্চননগর, হাসিমপুর ও জামিজুরীর ও ধোপাছড়ির পাহাড়ি এলাকায় চাষ হয় পেয়ারার। এখন চলছে পেয়ারার মৌসুম, শেষ রাতে বাগান থেকে পেয়ারা সংগ্রহ করে লাল কাপড়ের পুটলি বেঁধে কাঁধে বয়ে হাটে নিয়ে যান ব্যবসায়ীরা।
ভোরে চন্দনাইশের কয়েকটি জায়গায় বসে হাট। এই অঞ্চলে পেয়ারার সবচেয়ে বড় বাজার বসে রৌশন হাটে। এখান থেকে বেপারিরা কিনে নিয়ে যান দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। এই পেয়ারার সুখ্যাতি দেশের গন্ডি পেরিয়ে বিস্তৃত হয়েছে মধ্যপ্রাচ্যেও। প্রতি বছরই এখান থেকে বিদেশে রপ্তানি হয় সুস্বাদু পেয়ারা।
স্থানীয় কৃষি অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, দক্ষিণ চট্টগ্রামের চন্দনাইশ, পটিয়া, সাতকানিয়া, বাঁশখালী, লোহাগাড়া ও বোয়ালখালী উপজেলায় অন্তত ১০-১২ হাজার একর পাহাড় ও পাহাড়ের পাদদেশে পেয়ারা বাগান ছিল। এখন সেই পরিমাণ পেয়ারা বাগান নেই।
জানা গেছে, দক্ষিণ চট্টগ্রামজুড়ে এই পেয়ারা চাষ হলেও মূলত চন্দনাইশ উপজেলাই হলো কাঞ্চননগর জাতের পেয়ারার উৎপত্তিস্থল। এখানকার পাহাড় ও পাহাড়ের পাদদেশে বিশেষ করে হাশিমপুর, জঙ্গল হাশিমপুর, ছৈয়দাবাদ, লট এলাহাবাদ, কাঞ্চননগর, দোহাজারী, ধোপাছড়ি ও ধোপাছড়ি, পটিয়ার কেলিশহর, হাইদগাঁও, শ্রীমাই এলাকার উৎপাদিত পেয়ারা সর্বোৎকৃষ্টমানের পেয়ার উৎপন্ন হয়ে আসছে।
কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ জানা গেছে পূর্বে প্রতি মৌসুমে পেয়ারা বাগানগুলোতে হেক্টর প্রতি গড়ে ১৫ থেকে ১৬ মেট্রিক টন করে পেয়ারা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হতো। মৌসুমে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের পাশ ঘেঁষে গড়ে ওঠা দোহাজারী, বাগিচাহাট, খাঁনহাট, কাঞ্চননগর, চক্রশালা, হামিশপুর, বাদামতল, রৌশন হাট ও কমল মুন্সির হাট এলাকায় রীতিমতো বসত পাইকারি পেয়ারার হাট বা বাজার। এখনো বসছে তবে তা সীমিত আকারে। উপর্যুক্ত কারণে গত কয়েক বছর ধরে পেয়ারার বাগান যেমন কমে আসছে, তেমনি পেয়ারার ফলনও কমে আসছে। চলতি মৌসুমে তা আরো প্রকট আকার ধারণ করেছে।
পেয়ারা চাষ বদলে দিয়েছে হাজারো কৃষকের ভাগ্য, আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার পাশাপাশি কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে হাজারো পরিবারের। তবে এ মৌসুমে মহামারি করোনা ভাইরাসের কারণে অন্য বছরের তুলনায় কিছুটা মন্দা চলছে ব্যবসা।
জনশ্রুতি আছে, ১৮৫০ সালের দিকে পটিয়ার কচুয়াই চা বাগানের মালিক হেগিন্স লন্ডন থেকে প্রথমে আনারস পরে পেয়ারা ও লিচু এনে তার বাংলোর আশপাশে রোপণ করেন। পরে ঐ বীজ থেকে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে বাগানে পরিণত হয়।
পেয়ারা সংরক্ষণের জন্য এ অঞ্চলে কোনো হিমাগার নেই। থাকলে হয়তো লাখ লাখ টাকার পেয়ারা নষ্ট হওয়ার হাত থেকে রক্ষা পেত।