চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত আট মাসে সারা দেশে ৩৬১ জন স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও মাদ্রাসা শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। তাদের মধ্যে স্কুলগামী মেয়েদের সংখ্যা বেশি। প্রতি মাসে গড়ে ৪৫ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। ঢাকা বিভাগে সবচেয়ে শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। ২০২২ সালের একই সময়ে ৩৬৪ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছিল।
শনিবার অনলাইনে আয়োজিত ‘শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার হার ক্রমবর্ধমান : কোন পথে সমাধান’ শীর্ষক সমীক্ষার ফলাফলে এ তথ্য জানানো হয়। বেসরকারি সংস্থা ‘আঁচল ফাউন্ডেশন’ সমীক্ষাটি করেছে।
সমীক্ষায় বলা হয়, আত্মহত্যাকারী ৩৬১ শিক্ষার্থীর মধ্যে ১৪৭ জন ছেলে এবং ২১৪ জন মেয়ে। এর মধ্যে ১৬৯ জন স্কুলশিক্ষার্থী, ৯৬ জন কলেজ, ৬৬ জন বিশ্ববিদ্যালয় এবং ৩০ জন মাদ্রাসা শিক্ষার্থী। দেশের ১০৫টি জাতীয়, স্থানীয় পত্রিকা এবং অনলাইন পোর্টাল থেকে আত্মহত্যার তথ্য সংগ্রহ করে সংস্থাটি। এ বছর ঢাকা বিভাগে সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে। এ বিভাগে আত্মহত্যার হার ৩১ দশমিক ৩০ শতাংশ। এছাড়া খুলনা বিভাগে ১৩ শতাংশ, চট্টগ্রামে ১৪ দশমিক ১০ শতাংশ, রংপুরে ৮ দশমিক ৯০ শতাংশ, ময়মনসিংহে ১০ শতাংশ, রাজশাহীতে ১১ দশমিক ৯০ শতাংশ, বরিশালে ৮ দশমিক ৩০ শতাংশ এবং সিলেটে ২ দশমিক ৫ শতাংশ আত্মহত্যা করেছে। আত্মহত্যার ক্ষেত্রে সংখ্যায় মেয়েরা বেশি। ৫৯ দশমিক ৩০ শতাংশ মেয়ে শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। ৪০ দশমিক ৭০ শতাংশ ছেলে শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়- অভিমানে ২৬ দশমিক ৬০ শতাংশ, প্রেমঘটিত কারণে ১৮ দশমিক ৭০ শতাংশ, পড়াশোনার চাপ ও ব্যর্থতায় ১২ দশমিক ৬০ শতাংশ, পারিবারিক বিবাদে ৯ দশমিক ৮০ শতাংশ, মানসিক ভারসাম্যহীনতায় ৮ দশমিক ৪০ শতাংশ মেয়ে যৌন হয়রানিতে ৫ দশমিক ১০ শতাংশ মেয়ে আত্মহত্যা করে। সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যা করেছে স্কুল শিক্ষার্থী। আত্মহত্যাকারীদের মধ্যে ৪৬ দশমিক ৮ শতাংশ স্কুলশিক্ষার্থী। তাদের মধ্যে ১১২ জন মেয়ে এবং ৫৭ জন ছেলে। এছাড়া ২৬ দশমিক ৬০ শতাংশ কলেজ, ১৮ দশমিক ৩০ শতাংশ বিশ্ববিদ্যালয় এবং ৮ দশমিক ৩১ শতাংশ মাদ্রাসার শিক্ষার্থী। ৩০ জন মাদ্রাসা শিক্ষার্থীর মধ্যে ৫৩ দশমিক ৩০ শতাংশ মেয়ে এবং ৪৬ দশমিক ৭০ শতাংশ ছেলে। মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের ৪০ শতাংশের আত্মহত্যার পেছনে কারণ অভিমান। আর ১৩ দশমিক ৩০ শতাংশ প্রেমঘটিত সম্পর্কে এবং ১০ শতাংশ যৌন নির্যাতনে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে আঁচল ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি তানসেন রোজ বলেন, এর আগে আত্মহত্যার পেছনে প্রেমঘটিত সম্পর্ককে দায়ী করা হয়েছিল। কিন্তু এবারে ভিন্ন তথ্য সামনে এসেছে। আত্মহত্যার পেছনে মূল ভ‚মিকা রাখছে অভিমান। অভিমানের কারণে আত্মহত্যা পরিবারের সঙ্গে সন্তানদের সম্পর্ক কতটুকু মজবুত তা নিয়ে চিন্তার উদ্রেক করে। গত বছর আত্মহত্যার পেছনে করোনা একটা বড় ধরনের ভূমিকা রেখেছিল। এ বছর করোনা না থাকলেও আত্মহত্যার সংখ্যা আমাদের আশঙ্কা বাড়িয়ে দেয়।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দীন আহমদ বলেন, ‘২০২২ ও ২০২৩ সালে আত্মহত্যার সংখ্যাটি কাছাকাছি। অভিমান কিন্তু অনেকেই করে- সবাই আত্মহত্যা করে না। আবার অনেকে প্রেমে ব্যর্থ হয়- সবাই আত্মহত্যা করে না। এসব বিষয়ে আমরা দৃষ্টি দেব তবে একজন মানুষের ঘাত সহনশীলতার দিক আমরা বিবেচনায় নেব। তিনি আরও বলেন, আমাদের উচিত শারীরিক-মানসিক স্বাস্থ্যের দিকে মনোযোগী হওয়া। পরিবারের পাশাপাশি শিক্ষকদেরও মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি দায়িত্বশীল হতে হবে।
আত্মহত্যাপ্রবণ ১৭৭ নারীর মধ্যে ১২২ জনই মাদকাসক্ত : ২০১১ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৩ সালের আগস্ট পর্যন্ত মাদকাসক্ত চিকিৎসা ও পুনর্বাসন কেন্দ্রে সেবাগ্রহণকারী ৩২২ জন নারীর মধ্যে ১৭৭ জনের আত্মহত্যার প্রবণতা ছিল। এর মধ্যে ৯৮ জন কখনো না কখনো আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে এবং পাঁচজন শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যা করেছে। বিশ্ব আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবস উপলক্ষ্যে শনিবার আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশন এ তথ্য প্রকাশ করে। রাজধানীর শ্যামলীতে প্রতিষ্ঠানটির স্বাস্থ্য সেক্টরের সভাকক্ষে সংবাদ সম্মেলনের বিষয় ছিল ‘আত্মহত্যা প্রতিরোধে সচেতনতা, মাদকনির্ভরশীল ব্যক্তি এবং আত্মহত্যার উচ্চ ঝুঁকি।’
সংবাদ সম্মেলনে ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশন নারী মাদকাসক্ত চিকিৎসা ও পুনর্বাসন কেন্দ্রের কাউন্সিলর জান্নাতুল ফেরদৌস মজুমদার বলেন, আত্মহত্যার গড় হারে ২০১১ সালে বাংলাদেশ ছিল বিশ্বের ৩৮তম দেশ। কিন্তু ২০১৪ সালে বাংলাদেশ ১০তম স্থানে উঠে আসে। বাংলাদেশে আত্মহত্যার কারণগুলো হলো- শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, শারীরিক ও মানসিক অসুস্থতা, পারিবারিক কলহ এবং সম্পর্কের বিচ্ছেদ, মাদকের অপব্যবহার, অর্থনৈতিক সমস্যা, পড়াশোনার চাপ, বেকারত্ব, পারিবারিক আত্মহত্যার ইতিহাস ইত্যাদি।