শাহবাগ থানায় আটকে ছাত্রলীগের তিন নেতাকে মারধরের ঘটনায় ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) তদন্তে সাময়িক বরখাস্ত অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) হারুন অর রশিদের দায় পেয়েছে তদন্ত কমিটি। পাশাপাশি পুলিশের এডিসি সানজিদা আফরিন, তার স্বামী রাষ্ট্রপতির সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) আজিজুল হক এবং ঘটনায় জড়িত ছাত্রলীগ নেতাদেরও দায় পাওয়া গেছে।
তদন্ত কমিটি সূত্র বলছে, ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বের জেরে ঘটে যাওয়া এই ঘটনায় পুলিশ ও প্রশাসনের সুনাম ক্ষুণ্ন হয়েছে। জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, এ ঘটনার তদন্ত শেষ হয়েছে। মঙ্গলবার ডিএমপি কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুকের কাছে প্রতিবেদন জমা দেওয়া হবে।
৯ সেপ্টেম্বর রাতে বারডেম হাসপাতাল থেকে তুলে নিয়ে শাহবাগ থানায় আটকে ছাত্রলীগের দুই কেন্দ্রীয় নেতা এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক নেতাকে ব্যাপক মারধর করা হয়। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, পুলিশের রমনা বিভাগের তৎকালীন এডিসি হারুন অর রশিদ এই মারধরে নেতৃত্ব দেন। পরে তাকে সাময়িক বরখাস্ত করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এ ঘটনায় শাহবাগ থানার পরিদর্শক (অপারেশন) গোলাম মোস্তফাকেও দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়।
ঘটনার সূত্রপাতের বিষয়ে রাষ্ট্রপতির এপিএস আজিজুল হকের স্ত্রী ডিএমপির এডিসি (অতিরিক্ত উপকমিশনার) সানজিদা আফরিন এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, তিনি চিকিৎসা নিতে ওই দিন সন্ধ্যায় বারডেম হাসপাতালে গিয়েছিলেন। চিকিৎসকের সাক্ষাৎ পেতে তিনি সহকর্মী হিসেবে এডিসি হারুন অর রশিদের সহায়তা নেন। এ সময় কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে হাসপাতালে এসে এডিসি হারুনকে মারধর করেন তার স্বামী আজিজুল।
তদন্তসংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, হাসপাতাল থেকে নেওয়ার পর শাহবাগ থানার ওসির কক্ষে আটকে ছাত্রলীগের তিন নেতাকে মারধর করে পুলিশ। এডিসি হারুনের নেতৃত্বে শাহবাগ থানার পরিদর্শক গোলাম মোস্তফাসহ বেশ কয়েকজন পুলিশ সদস্য ছাত্রলীগ নেতাদের মারধর করেন।
এই ঘটনা তদন্তে তিন সদস্যের একটি কমিটি করে ডিএমপি। কমিটির সভাপতি ডিএমপি সদর দপ্তরের উপপুলিশ কমিশনার (অপারেশনস) আবু ইউসুফ। অপর দুই সদস্য রমনা বিভাগের অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার (নিউমার্কেট জোন) শাহেন শাহ ও অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার (গোয়েন্দা-মতিঝিল বিভাগ) মো. রফিকুল ইসলাম। কমিটিকে প্রথমে ১৩ সেপ্টেম্বর প্রতিবেদন দিতে বলা হয়। কিন্তু তদন্ত শেষ না করতে পারায় আরও পাঁচ দিন সময় বাড়ানো হয়। সোমবার এই পাঁচ দিন শেষ হয়েছে।
মঙ্গলবার তাদের প্রতিবেদন দেওয়ার কথা। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, কমিটি ইতোমধ্যে সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ শেষ করেছে। ঘটনাস্থল বারডেম হাসপাতালের সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজও সংগ্রহ করেছে।
এদিকে তদন্ত কমিটি হারুন-সানজিদার পাশাপাশি পুলিশ পরিদর্শক মো. গোলাম মোস্তফাসহ ছাত্রলীগের ভুক্তভোগী নেতা এবং ইব্রাহিম কার্ডিয়াক হাসপাতাল ও থানার প্রত্যক্ষদর্শীদেরও সাক্ষ্য নিয়েছে। তাদের প্রায় সবার জবানিতে হারুনের বিরুদ্ধে নির্যাতনের অভিযোগ উঠেছে। এর পাশাপাশি পরিদর্শক মোস্তফার আগ্রাসী ভূমিকার বিষয়টিও এসেছে। যে ৪০-৪২ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়েছে, ঘটনায় সম্পৃক্ততা নিরূপণে তাদের বক্তব্যও বিশ্লেষণ করে তদন্ত প্রতিবেদনে তুলে ধরা হচ্ছে।
তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, শাহবাগ থানায় নির্যাতনের সময় যারা উপস্থিত ছিলেন, তাদের ভূমিকাও নিরূপণ করা হয়েছে। ছাত্রলীগ নেতাদের পক্ষ থেকে ১০-১৫ জন পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে নির্যাতনের অভিযোগ ছিল। তারা কারা, পুলিশের তদন্তে তা বের করা হয়েছে। কমিটি জানতে পেরেছে, উপস্থিত সব পুলিশ সদস্য ছাত্রলীগ নেতাদের মারধর করেছেন, বিষয়টি এমনও নয়। কেউ কেউ মেরেছেন। কেউ করেছেন গালগাল। নীরব ভূমিকায়ও ছিলেন কেউ কেউ। যাদের বক্তব্য নেওয়া হয়েছে, তাদের কাছ থেকে ঘটনার আদ্যোপান্ত জানতে পেরেছে কমিটি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তদন্তসংশ্লিষ্ট ডিএমপির এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা সোমবার বিকালে যুগান্তরকে বলেন, ‘তদন্ত কমিটির কাছে লিখিত বক্তব্য নিয়ে যান এপিএস আজিজুল হক খান মামুন। এর আগে অন্যদের বক্তব্যও গ্রহণ করা হয়। সবার বক্তব্য বিশ্লেষণ করে প্রতিবেদন চূড়ান্ত করে দাখিল করা হচ্ছে। এতে ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত প্রত্যেকের ভূমিকা তুলে ধরবে কমিটি। এরপর বিভাগীয় তদন্ত হবে। তদন্ত কমিটি দোষীদের বিষয়ে শাস্তির সুপারিশ করবে।’