ঘুষের রেট নির্ধারণ করে দেওয়া পিরোজপুরের নাজিপুর উপজেলার সেই এসিল্যান্ড মাসুদুর রহমানকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে সরকার। তদন্তে অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা পাওয়ায় আজ বুধবার জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
রাষ্ট্রপতির আদেশে প্রজ্ঞাপনে সই করেন মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব মো. আব্দুস সবুর মন্ডল।
প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, মাসুদুর রহমানের বিরুদ্ধে তার সহকর্মীদের নামজারি মামলায় অবৈধ অর্থ লেনদেন সংক্রান্ত নির্দেশনা প্রদানের অভিযোগ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। পিরোজপুর জেলা প্রশাসক কর্তৃক গঠিত ৩ সদস্যের তদন্ত কমিটি অডিও ক্লিপের কথোপকথনের বিষয়ে তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিল করেছেন এবং তদন্তে অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা পেয়েছেন। মাসুদুর রহমানের এরূপ আচরণকে সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, ২০১৮ এর ৩(খ) বিধি মোতাবেক অসদাচরণ হিসেবে গণ্য করে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা রুজু করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের প্রস্তাব করেছেন বরিশাল বিভাগীয় কমিশনার।
প্রজ্ঞাপনে আরও বলা হয়, মাসুদুর রহমানকে তার দায়িত্ব থেকে বিরত রাখা আবশ্যক। সরকারি চাকরি আইন, ২০১৮ এর ধারা ৩৯(১) অনুযায়ী সরকারি চাকরি হতে সাময়িক বরখাস্ত করা হলো। সাময়িক বরখাস্তকালীন মাসুদুর রহমান জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (সহকারী সচিব) হিসেবে সংযুক্ত থাকবেন এবং বিধি অনুযায়ী খোরপোষ ভাতা প্রাপ্য হবেন। জনস্বার্থে এ আদেশ জারি করা হলো।
গত ১৮ সেপ্টেম্বর ‘এসিল্যান্ড বলে দিলেন নামজারিতে ঘুষ কত’ শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, গত জুলাই মাসে পিরোজপুরের নাজিরপুরে জমির নামজারি করার জন্য ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তারা ছয় হাজার টাকা ঘুষ নেবেন, এমন রেট নির্ধারণ করে দিয়েছেন এসিল্যান্ড বা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মাসুদুর রহমান। ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তাদের নিয়ে করা ওই সভার অডিও রেকর্ড ফাঁস হয়। এরপর জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তদন্ত কমিটি গঠন করে ঘটনার সত্যতা যাচাই করা হয়। এসিল্যান্ডকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেন নাজিরপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সঞ্জীব দাশ।
কোনো কারণে জমি হস্তান্তর হলে খতিয়ানে পুরোনো মালিকের নাম বাদ দিয়ে নতুন মালিকের নাম প্রতিস্থাপন করানোকে বলে নামজারি। উত্তরাধিকার সূত্রে, বিক্রয়, দান, খাসজমি বন্দোবস্তসহ বিভিন্ন ধরনের হস্তান্তরের কারণে জমির মালিকানা বদল হয়। নামজারি করতে সরকার নির্ধারিত ফি ১ হাজার ১৭০ টাকা। নাম খারজের পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেন উপজেলা ভূমি অফিস ও ইউনিয়ন ভূমি অফিসের কর্মকর্তারা। এ সংক্রান্ত কাজে অবৈধভাবে কত টাকা গ্রাহকদের কাছ থেকে আদায় করতে হবে, তারই এক ধরণের নির্দেশনা তার অধস্তনদের দিয়েছিলেন এসিল্যান্ড মাসুদুর রহমান। বিধি বাম, সেই নির্দেশনার অডিও রেকর্ড ফাঁস হয়ে যাওয়ায় ধরা পড়ে গেছেন।
এসিল্যান্ড তার নির্দেশনায় বলেছিলন, ‘এখান আমাকে পরিষ্কার করে একটি বিষয় আপনাদের অবগত করতে হবে, আমি ইউএনও স্যারের কাছ থেকে চাপে আছি। ধরেন, আমার অফিস থেকে নামজারিতে অতিরিক্ত আদায় বন্ধ করা হলো। আপনারা পার কেইস যে ডিল করেন, এটা আপনারা নিশ্চিত করবেন কীভাবে যে আপনারা টাকা নিচ্ছেন না। আপনাদের মতামত শুনি, আপনারা কী চান? কত করে নেওয়া হোক? খোলামেলা আলোচনা করেন, মতামত দেন। সবাই এখানে উপস্থিত আছেন। যদি বলেন স্যার, আপনি যদি না করে দেন, তাহলে নিশ্চিত করব আমরা কোনো টাকাপয়সার লেনদেন করব না। কিন্তু বাস্তবে এটা কখনো হবে না। আপনারা মাঠপর্যায়ে কাজ করেন। কাজ করতে গেলে স্বাভাবিকভাবেই মানে খরচ আছে এবং বিভিন্ন ধরনের বিষয় আছে, যেটার কারণে এটা নিতে হচ্ছে বা নিচ্ছেন। এটা কমবেশি সবাই নিচ্ছে। কিন্তু এটা যে এই অফিসে দেওয়া ইইতেছে বিধায় আপনারা এটাকে বড় আকারে একটা কিছু করবেন, এই ধরনের অভিযোগ আসলে আমার জন্য বিব্রতকর।’
ওইদিনের সভায় এসিল্যান্ড আরও বলেন, ‘এ ব্যাপারে আমার সাথে শাখারীকাঠী ইউনিয়ন তহসিলদার মো. শাখাওয়াত সাহেবের সব বিষয়ে কথা হয়েছে। ধরেন, একজনের দুই একর জমি আছে, তার কাছ থেকে নামজারির ক্ষেত্রে কত টাকা নেবেন? যেহেতু তার জমি বেশি, তার কাছ থেকে বেশি টাকা নেবেন, এ রকম।’
এমন কথার উত্তরে এক কর্মকর্তা বলেন, ‘টাকা সবার জন্য সমান হওয়া উচিত। যেমন পাঁচ হাজার ছিল, সেখানে আপনি বললে, চার হাজার টাকায় নামিয়ে আনতে পারি। আপনি যেভাবে বলবেন স্যার।’ তখন এসিল্যান্ড বলেন, ‘ধরেন, আমি চার হাজার নির্ধারণ করে দিলাম। আপনারা কত ডিল করবেন? ক্লিয়ার কথা বলেন। প্রয়োজনে কথাগুলো রেকর্ড থাকবে।’ এর পরিপ্রেক্ষিতে ওপর এক কর্মকর্তা বলেন, ‘সর্বোচ্চ ৬-এর বেশি আমরা নেব না।’ তখন এসিল্যান্ড মাসুদুর রহমান আবার বলেন, ‘ছয় হাজার মানে ছয় হাজারই। ছয় হাজার ১০০ টাকা হলে পরবর্তী সময়ে আমি ব্যবস্থা নেব।’