নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে রাজনৈতিক সংকটের মধ্যে আজ বুধবার নির্বাচন কমিশন (ইসি) দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করতে পারে বলে কমিশন সূত্রে জানা গেছে।
এর আগে নভেম্বরের প্রথমার্ধেই আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল দেওয়ার কথা জানিয়েছিল কমিশন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে গতকাল মঙ্গলবার ইসি সচিব জাহাংগীর আলম সাংবাদিককদের বলেন, ‘কবে, কখন, কীভাবে তফসিল ঘোষিত হবে তা আগামীকাল (আজ সকাল ১০টায়) ব্রিফিংয়ের মাধ্যমে কমিশন জানিয়ে দেবে।’ তিনি বলেন, তফসিল ঘোষণার দিন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বেতারে ভাষণের মাধ্যমে জাতির কাছে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোটের সূচি তুলে ধরবেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গতকাল এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, হয়তো দু-একদিনের মধ্যেই নির্বাচন কমিশন নির্বাচনের তারিখ ও সময় (তফসিল) ঘোষণা করবে।
প্রথা অনুযায়ী গত বৃহস্পতিবার রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও চার কমিশনার। নির্বাচনের সার্বিক প্রস্তুতির বিষয়টি রাষ্ট্রপতিকে অবহিত করা হয়েছে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে সাংবিধানিক রীতিনীতি অনুসরণ করে নির্বাচন কমিশনকে সাহসিকতা ও আন্তরিকতার সঙ্গে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালনের আহ্বান জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেছিলেন, ‘সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণে ২৯ জানুয়ারির মধ্যে নির্বাচন সম্পন্ন করতে হবে। দ্রুত আমরা তফসিল ঘোষণা করব, কারণ সময় হয়ে গেছে।’
সরকারের পদত্যাগ ও নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে মাঠের বড় বিরোধী দল বিএনপি ও সমমনা দলগুলো লাগাতার অবরোধ কর্মসূচি পালন করে যাচ্ছে। এসব কর্মসূচি ঘিরে সহিংসতার ঘটনাও ঘটছে। তফসিল ঘোষণার পর দলটি আরও কঠিন কর্মসূচি দিতে পারে, এমন আভাস দিয়ে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। তাদের সঙ্গে একই সুরে হরতাল অবরোধের মতো কর্মসূচি দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন কয়েকটি বামপন্থি দলের নেতারা। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশও তফসিল ঘোষণার দিন নির্বাচন কমিশন অভিমুখে গণমিছিলের কর্মসূচি দিয়েছে। আন্দোলন প্রতিহত করার ঘোষণা আগেই দিয়েছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। দলটি বলছে, সংবিধান অনুযায়ী বর্তমান সরকারের অধীনেই নির্বাচন হবে।
অন্যদিকে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে জাতীয় পার্টি। দলটির নেতারা বলছেন, জাতীয় পার্টির মধ্যে আগামী নির্বাচন নিয়ে এখনো শঙ্কা রয়েছে। গত ২৮ অক্টোবরকে কেন্দ্র করে এক ধরনের সংঘাত-সংঘর্ষের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। তবে পরিস্থিতি যাই হোক, দেশি-বিদেশিসহ সার্বিক পরিস্থিতির দিকে গভীর নজর রাখছে দলটি। ফলে সার্বিক পরিস্থিতি মূল্যায়ন করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে বলে জানিয়েছেন জাতীয় পার্টির নেতারা।
এর আগে গত ৪ নভেম্বর নির্বাচনী প্রস্তুতি বিষয়ে আলোচনার জন্য নিবন্ধিত ৪৪টি দলকে আমন্ত্রণ জানায় নির্বাচন কমিশন। কিন্তু দুই পর্বের আলোচনায় উপস্থিত হয়েছিল ২৬টি দল। বাকি ১৮ দলের মধ্যে বিএনপি ও সমমনা দল ছাড়াও বামপন্থি কিছু দল আমন্ত্রণেই সাড়া দেয়নি। এই সরকারের অধীনে ইসি সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন করতে পারবে ওইসব মনে করছে না। এ ছাড়া যারা আলোচনায় এসেছেন তাদের মধ্যেও একাংশ মনে করেন, নির্বাচনের পরিবেশ এখনো ঠিক হয়নি। পরিস্থিতি বুঝে তারা নির্বাচনে যাবেন কি যাবেন না সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানাবেন।
গত ২৮ অক্টোবর ঢাকায় সমাবেশ পণ্ড হওয়ার পর থেকে ধারাবাহিকভাবে অবরোধের কর্মসূচি পালন করে আসছে বিএনপি। পঞ্চম দফার ৪৮ ঘণ্টার অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণা করে বিএনপি জানিয়েছে, তফসিল ঘোষণার আগ পর্যন্ত এমন কর্মসূচি চলবে।
সম্প্রতি বাম গণতান্ত্রিক জোট নির্বাচন নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করে বলেছে, দেশের সংঘাতময় পরিস্থিতির অবসানের লক্ষ্যে অবিলম্বে সরকারকে পদত্যাগ ও নিরপেক্ষ তদারকির বিষয় নিয়ে আলোচনায় বসতে হবে। সরকার নির্বাচন কমিশনের মাধ্যমে যদি একতরফা প্রহসনমূলক নির্বাচন আয়োজন করতে চায় তাহলে তফসিল ঘোষণার পরদিন থেকে হরতাল-অবরোধসহ কঠোর কর্মসূচি শুরু হবে।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির দশম সংসদ নির্বাচনের আগে আগেও এই ধরনের রাজনৈতিক অচলাবস্থা তৈরি হয়েছিল। বিরোধীদের বর্জন ও প্রতিহতের ঘোষণায় ব্যাপক সহিংসতার মধ্য দিয়ে নির্বাচন হয়। অর্ধেকের বেশি আসনে প্রার্থীরা নির্বাচিত হন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়।
২০১৮ সালে সব দলের অংশগ্রহণে একাদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ ওঠে। বিএনপিসহ সমমনা দলগুলো ভোটের দিন দুপরের পর থেকে নির্বাচন বর্জন করে।
তফসিলকে কেন্দ্র করে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো সর্বাত্মক কর্মসূচি ঘোষণা করলে কমিশন নতুন করে চাপে পড়ে যাবে বলে মনে করেন নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে ২০১৪ ও ২০১৮ সালের মতো এবারের পরিস্থিতি নয়। ফলে রাজনৈতিক সমঝোতা না হলে নির্বাচন সংক্রান্ত কাজ ঠিকভাবে সম্পন্ন করতে বেশ বেগ পেতে হবে আউয়াল কমিশনকে।
নির্বাচন পর্যবেক্ষক সংস্থা জানিপপের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ বলেন, ‘বিভিন্ন সময় প্রধান নির্বাচন কমিশনার রাজনৈতিক সমঝোতার কথা বলেছেন। তিনি মনেপ্রাণে চেয়েছেন রাজনৈতিক মতভেদ দূর হোক। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলোর কোনো উদ্যোগ নেই। এরমধ্যে তফসিলকে কেন্দ্র করে যদি নতুন করে সব দল একযোগে আন্দোলন কর্মসূচি দেয় তাহলে পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা এখনই বলা মুশকিল। তবে যাই হোক না কেন তা দেশের জন্য মঙ্গলজনক হবে না।’