রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ও সদিচ্ছা ছাড়া কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। শুধু আইনের কঠোরতা দিয়ে কিশোর গ্যাং সংকট উত্তরণ করা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয় ।এর নেপথ্যে মদদ-দাতাদের চিহ্নিত করে তাদেরও আইনের আওতায় আনতে হবে ।সাথে সাথে ঢাকা, চট্টগ্রাম সহ সারা দেশে কিশোর গ্যাং এর উত্থান রোধে প্রশাসন, রাজনৈতিক দল, মিডিয়া, শিক্ষক,শিক্ষার্থী , অভিভাবক সহ সংশ্লিষ্ট সকলকে যুগোপৎ ভূমিকা পালন করতে হবে । গড়ে তুলতে হবে আধুনিক শিশু কিশোর বান্ধব সংশোধন বা কারেকশান ব্যবস্থা । গ্যাং কালচার নিয়ন্ত্রণে এর কারণ চিহ্নিত করে তা নির্মূলের ব্যবস্থা নিতে হবে।
” গত ২২ শে অক্টোবর ২০২৩ রোববার ঢাকা মহানগরীর তোপখানা রোডস্থ সিরডাপ মিলনায়তনে সকাল সাড়ে নয়টা থেকে দুপুর দুইটা পর্যন্ত বাংলাদেশের অন্যতম বৃহত্তম মানবাধিকার সংগঠন বাংলাদেশ হিউম্যান রাইট্স ফাউন্ডেশন-বিএইচআরএফ আয়োজিত ‘কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণে প্রশাসন, রাজনৈতিক দল ও মিডিয়ার ভূমিকা এবং আমাদের করণীয়’- শীর্ষক এক্সেস টু জাস্টিস প্রোগ্রামের প্রধান অতিথি বিচারপতি ব্যারিস্টার শেখ হাসান আরিফ উপরোক্ত মন্তব্য করেন ।তিনি আরো বলেন, খারাপ সংবাদ যেভাবে প্রচার পায়, ভালো সংবাদ সেভাবে প্রচার হয় না। ফেসবুক, টিকটক ইত্যাদি সোশ্যাল মিডিয়ায় সঠিক নজরদারীর দায়িত্ব বিটিআরসির, তারা তা করছে না। রাজনৈতিক উঠতি নেতা, পাতি নেতারা টাকা পয়সা দিয়ে কিশোরদের ব্যবহার করে নিজের জনপ্রিয়তা ও ক্ষমতা দেখানোর জন্য। রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া পুলিশ,বিচারক, প্রশাসন,মিডিয়া কাউকে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না।
বিএইচআরএফ চেয়ারপার্সন মানবাধিকার নেত্রী এডভোকেট এলিনা খানের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত উক্ত সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বিএইচআরএফ মহাসচিব অ্যাডভোকেট জিয়া হাবীব আহসান, মুখ্য আলোচক ছিলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আইন অনুষদের শিক্ষক ও সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিসের পরিচালক প্রফেসর হাফিজুর রহমান কার্জন, অতিথি হিসেবে আলোচনায় আরো অংশ গ্রহন করেন ডিবেট ফর ডেমোক্রেসির চেয়াম্যান ও এটিএন বাংলার নির্বাহী পরিচালক প্রফেসর হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরন,সিনিয়র ক্রাইমস রিপোর্টার পারভেজ আহমেদ ।
স্বাগত বক্তব্য রাখেন বিএইচআরএফ ঢাকা মহানগর শাখার সভাপতি রোটারিয়ান এম রাকীব সরদার ও ধন্যবাদ বক্তব্য রাখেন সহ সাধারণ সম্পাদক সাদাত আর খান। সভায় বক্তাগণ বলেন,”সাইবার ওয়ার্ল্ডেও কিশোর গ্যাং এর সরব উপস্থিতি লক্ষ্যণীয় । খেলার মাঠ ও বিনোদনের জায়গা কেড়ে নিয়েছে ছোট্ট একটা এন্ড্রয়েড মোবাইল স্ক্রিন। যা আমাদের সন্তানদের অকর্মা, অসুস্থ মানসিক বিকারগ্রস্ত করে তুলছে। কিশোর গ্যাং এর রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা সম্পূর্ণ রূপে নিষিদ্ধ করতে হবে। বিশেষ করে আগামী নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলোকে অংগীকার করতে হবে তারা কোন শিশু কিশোরদের রাজনৈতিক কর্মকান্ডে ব্যবহার করবে না ।” অনুষ্ঠানে অন্যান্যদের মধ্যে আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন ফরেনসিক চিকিৎসক ডা.শাহ আলম, এডিসি ডিএমপি তেঁজগাঁ রুবাইয়াত জামান, এডিসি (প্রশাসন) রকিবুল ইসলাম, ডিআইজি প্রিজন নাহিদা পারভিন,এডিসি ডিএমপি একেএম সাজ্জাদুল আলম, এডিসি সানজিদা চৌধুরী, সূজন সমন্বয়ক দীলিপ কুমার সরকার, বৈশাখী টিভি’র সাংবাদিক তানজিনা নিঝুম,সাংবাদিক আরিফুর রহমান, মানবাধিকার কর্মী তাহমিনা বিনু, এম মাসূম সর্দার, কবি আঞ্জুমান আরা আরজু,টিচার্স ট্রেইনার মুমু আহমেদ,ডা আব্দূস সালাম ওসমানী, এডভোকেট সৈয়দ মোহাম্মদ হারুন, এডভোকেট অংশু আসিফ পিয়াল প্রমূখ সহ বিপুল সংখ্যক বিভিন্ন শ্রেণী পেশার প্রতিনিধি বৃন্দ।
আলোচকরা বলেন, টোকাইদের একটি বড় অংশ এবং রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণ হয়। ফলে তা নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। সহজে অর্থ উপার্জন ও ক্ষমতার ( পাওয়ার) নেশায় এলাকা ভিত্তিক কিশোর গ্যাং গড়ে ওঠে। কিশোর অপরাধ বন্ধ করতে সভায় পেশকৃত ২২ দফা সুপারিশমালা পেশ করা হয়।
সেগুলো হচ্ছে – ০১) জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের মতো “জাতীয় শিশু কিশোর অধিকার সূরক্ষা কমিশন গঠন করা, ০২) গ্যাং কালচার প্রতিরোধে রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনী অঙ্গীকার ও হলফনামা প্রদান করতে হবে, ০৩) পর্যাপ্ত খেলার মাঠ ও খেলার ব্যবস্থা করতে হবে, ০৪) টিক টক সহ সাইবার ওয়ার্ল্ড নিয়ন্ত্রণে বিটিসিএল কে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে, ০৫) মিডিয়ায় নেগেটিভ সংবাদের চেয়ে পজিটিভ সংবাদ বেশি প্রচার করতে হবে, ০৬) শিক্ষা ব্যবস্থায় সামাজিক বৈষম্য দূরীকরণ করতে হবে, ০৭) মোটিবেশন ও কাউন্সলিং ব্যবস্থা গ্রহন করতে হবে, ০৮) মাদক ব্যবসা সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, ০৯) কিশোরদের সুষ্ঠু আবেগীয় ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশে যত্নবান হতে হবে, ১০) সুবিধাবঞ্চিত ও দরিদ্র শিশু-কিশোরদের জন্য সুশিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে, ১১) কিশোরের সুষ্ঠু সামাজিকীকরণের জন্য গঠনমূলক পারিবারিক, সামাজিক ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। দেশে পর্যাপ্ত কিশোর সচেতনতামূলক লেখা, প্রবন্ধ, সাময়িকী এবং অপরাধ নিয়ন্ত্রণে উন্নয়ন কেন্দ্র গড়ে তুলতে হবে, ১২) আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কিশোর গ্যাং সম্পর্কে নির্ভুল তথ্য সংগ্রহ করে ডাটা বেইজ তৈরি করতে পারলে এ সমস্যা নিয়ন্ত্রণ করা অনেক সম্ভব। যেসব স্থানে গ্যাং সদস্যরা আড্ডা দেয় সেসব জায়গায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সরব উপস্থিতি থাকতে হবে। স্বজনপ্রীতি বাদ দিয়ে এসব গ্যাংয়ের পৃষ্ঠপোষক ও নিয়ন্ত্রকদের আইনের আওতায় আনতে হবে, ১৩) দেশের জনসাধারণকে উদ্বুদ্ধ ও সচেতন করতে হবে। অন্যদিকে সমাজের মানুষকেও সম্মিলিতভাবে কিশোর গ্যাংয়ের বিরুদ্ধে এগিয়ে আসতে হবে, ১৪) পিতামাতার উচিত প্রত্যেক ছেলেমেয়েকে উঠতি বয়সে নজরে রাখা । তারা কী করছে, কার সাথে মিশছে। কোথায় যাচ্ছে। সব সময় খোঁজ খবর রাখা এবং তাদের সঙ্গে বন্ধুর মতো মিশে সময় দেওয়া। আর সব চেয়ে বড় কথা হলো সন্তানকে নিজ নিজ ধর্মীয় অনুশাসন ও রীতিনীতি অনুযায়ী বড় করতে হবে, সেই সাথে পারিবারিক মূল্যবোধ এবং জবাবদিহিতার মধ্যে রাখতে হবে, ১৫) অপরাধের সাথে জড়িয়ে পড়া কিশোর সংশোধন এবং উন্নয়নের জন্য আলাদা হাজত, প্রশিক্ষণ কেন্দ্ৰ গড়ে তুলতে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গড়তে বিত্তশালীদেরও এগিয়ে আসতে হবে ।১৬) স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান ও গণমাধ্যমগুলো শিশুর মানসিক বিকাশের উপযোগী কার্যক্রম ও অনুষ্ঠান পরিচালনা করতে পারে, ১৭) কিছু কিশোরদের আটক করে গ্যাং কালচার নিয়ন্ত্রণে পুলিশের অভিযান দীর্ঘমেয়াদে কার্যকরী হাতিয়ার হতে পারে না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষার অংশ হিসেবে এ ধরনের অভিযান অপরিহার্য। কিশোর এবং তাদের অভিভাবকদের মধ্যে সচেতনতা তৈরির পাশাপাশি পরিবারে মূল্যবোধের অনুশীলন জরুরী, ১৮) ম্যাজিস্ট্রেটদের শিশু আইন, ২০১৩ এ বর্ণিত পদ্ধতির পরিবর্তে ফৌজদারি কার্যবিধি অনুসরণ করার প্রবণতা রয়েছে । এই প্রবণতা থেকে বেড়িয়ে না আসলে কিশোরদের জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা সম্ভব নয়, ১৯) আইনে প্রাপ্তবয়স্ক বন্দীদের সাথে শিশু ও কিশোরদের রাখার অনুমতি না দেওয়ার বিধান থাকা সত্ত্বেও, বাস্তবে এটির প্রয়োগ দেখা যায় না। কেন্দ্রীয় ও জেলা কারাগারের কারা কর্তৃপক্ষকে প্রাপ্তবয়স্কদের থেকে আলাদা রাখতে প্রযোজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে, ২০) কারাগারে কিশোরদের শারীরিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার হওয়ার অসংখ্য ঘটনা ঘটেছে। এধরণের ঘটনা রোধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে, ২১) প্রতিটি থানায় শিশু ও কিশোরদের সম্পর্কে আলাদা রেকর্ড ও রেজিস্টার থাকতে হবে, ২২) বাংলাদেশে কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্র অপর্যাপ্ত এবং নিম্নমানের । সময়োপযোগী উন্নয়ন কেন্দ্র গড়ে তুলতে হবে । উক্ত সুপারিশমালা সমূহ বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট সকলের আন্তরিক উদ্যোগ ও সহযোগীতা একান্ত প্রায়জন ।
লেখক: জিয়া হাবীব আহসান, এডভোকেট, মহাসচিব, বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশন বিএইচআরএফ।