এক দিন পরই ৭ জানুয়ারি রোববার দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। গতকাল বৃহস্পতিবার শেষ সময়ে ব্যস্ত ছিলেন প্রার্থীরা। এরই মধ্যে দেশজুড়ে নিরাপত্তা বলয় গড়ে তুলেছে পুলিশ-র্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণভাবে নির্বাচন সম্পন্নে বেসামরিক প্রশাসনকে সহায়তা দিতে মোতায়েন করা হয়েছে সেনাবাহিনী ও বিজিবি। দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে দায়িত্ব পালন শুরু করেছে নৌবাহিনী ও কোস্টগার্ড।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সূত্রগুলো বলছে, এরই মধ্যে ভোটের আগের দিন শনিবার, ভোটের দিন রোববার এবং এর পরের দিন সোমবার—এই তিন দিন ঘিরে নিরাপত্তা ছক তৈরি করা হয়েছে। সে অনুযায়ী কার্যক্রমও চলছে। ভোটের দিন ছাড়াও পরবর্তী দিনগুলোতে কোনো ধরনের সহিংসতা হলে তা দমনেও কঠোর থাকবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ৭ জানুয়ারি নির্বাচনে পরও ১০ জানুয়ারি পর্যন্ত মাঠে থাকবে সশস্ত্র বাহিনী।
সূত্রগুলো বলছে, পুলিশের পক্ষ থেকে ভোটের দিন চার স্তরের নিরাপত্তা বলয় গড়ে তোলার পরিকল্পনা করেছে। এই বলয়ের মধ্যে প্রথম স্তরে ভোটকেন্দ্রের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, দ্বিতীয়ত স্তরে ভোটকেন্দ্রের বাইরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, তৃতীয় স্তরে সড়কে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং সমাগমস্থলে মোবাইল টিম সক্রিয় রাখা হবে। এর বাইরে বিভাগীয় শহরসহ দেশের জেলা শহর থেকে শুরু করে বড় শহরগুলোর মূল সড়কে তল্লাশি ও টহল জোরদার করার পরিকল্পনা করা হয়েছে। ভোটকেন্দ্রে পুলিশ, আনসার মিলিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ১৬ থেকে ১৭ জন করে সার্বক্ষণিক নিরাপত্তা দায়িত্ব পালন করবে। তবে সেনা, বিজিবি, পুলিশ, র্যাব ও আনসার বাহিনীর স্ট্রাইকিং ফোর্স পুরো নির্বাচনী এলাকায় টহল নিশ্চিত করবে।
পুলিশ সদর দপ্তরের উপমহাপরিদর্শক (অপারেশন্স) মো. আনোয়ার হোসেন কালবেলাকে বলেন, শান্তিপূর্ণ পরিবেশে নির্বাচন অনুষ্ঠান এবং নির্ভয়ে যাতে ভোটাররা ভোটকেন্দ্রে যেতে পারেন, নিজের ইচ্ছায় ভোট দিতে পারেন—সেই পরিবেশ নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় সব নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, সশস্ত্র বাহিনী, বিজিবি ও আনসার বাহিনী ছাড়াও নির্বাচনে পুলিশের প্রায় সোয়া দুই লাখ সদস্যই কোনো না কোনোভাবে নির্বাচনের কাজে যুক্ত থাকবে। এর মধ্যে সরাসরি ভোটকেন্দ্রের দায়িত্বে থাকবে পুলিশের ৯২ হাজার সদস্য, ভ্রাম্যমাণ ও স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে পুলিশের আরও ২০ হাজারের বেশি সদস্য এবং নির্বাচন কমিশন, রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়সহ বিভিন্নভাবে আরও ৫৬ হাজার পুলিশ সদস্য নির্বাচনী কাজে যুক্ত থাকবেন। এরই মধ্যে সবার দায়িত্ব বণ্টন করা হয়েছে।
আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) জানিয়েছে, ৭ জানুয়ারি জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন করার লক্ষ্যে স্থানীয় বেসামরিক প্রশাসনকে সহায়তা প্রদানের নিমিত্তে সংবিধানের ১২৬ অনুচ্ছেদ অনুসারে ‘ইন এইড টু দি সিভিল পাওয়ার’-এর আওতায় সশস্ত্র বাহিনী নিয়োজিত হয়েছে। সশস্ত্র বাহিনী ভোট গ্রহণের আগে, ভোট গ্রহণের দিন ও ভোট গ্রহণের পরে শান্তি-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে দেশব্যাপী ১০ জানুয়ারি পর্যন্ত নির্বাচন কমিশন, স্থানীয় বেসামরিক প্রশাসনকে সহায়তা প্রদান করবে।
সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা প্রতিটি জেলা, উপজেলা ও মেট্রোপলিটন এলাকার নোডাল পয়েন্ট ও অন্যান্য সুবিধাজনক স্থানে অবস্থান করবে। সংশ্লিষ্ট রিটার্নিং কর্মকর্তার অনুরোধক্রমে ও সমন্বয়ের মাধ্যমে বাহিনীসমূহ এলাকাভিত্তিক মোতায়েন সম্পন্ন করছে। সেনাবাহিনী ৬২টি জেলায় নিয়োজিত হয়েছে। সমতলে সীমান্তবর্তী ৪৫টি উপজেলায় বিজিবি এককভাবে দায়িত্ব পালন করবে; তবে সীমান্তবর্তী ৪৭টি উপজেলায় সেনাবাহিনী বিজিবির সঙ্গে এবং উপকূলীয় ৪টি উপজেলায় কোস্টগার্ডের সঙ্গে সমন্বয়ের মাধ্যমে যৌথভাবে দায়িত্ব পালন করছে। উপকূলীয় দুটি জেলা ভোলা, বরগুনাসহ মোট ১৯টি উপজেলায় নৌবাহিনী দায়িত্ব পালন করছে। বিমানবাহিনী হেলিকপ্টারে দুর্গম পার্বত্য অঞ্চলের ভোটকেন্দ্রগুলোতে প্রয়োজনীয় হেলিকপ্টার সহায়তা প্রদান করছে। এ ছাড়াও জরুরি প্রয়োজনে নির্বাচনী সহায়তা প্রদানের লক্ষ্যে বিমানবাহিনীর প্রয়োজনীয় সংখ্যক হেলিকপ্টার প্রস্তুত রাখা হয়েছে।
এদিকে গতকাল বৃহস্পতিবার সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল এস এম শফিউদ্দিন আহমেদ যশোর অঞ্চলে আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মোতায়েন করা সেনাবাহিনীর কার্যক্রম পরিদর্শন করেছেন। তিনি মোতায়েন করা সেনাসদস্যদের কার্যক্রম সরেজমিন প্রত্যক্ষ করার পাশাপাশি কর্তব্যরত সেনাসদস্যদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন ও প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দেন। যশোর অঞ্চল পরিদর্শন শেষে সেনাবাহিনী প্রধান সাভার ও ঢাকায় মোতায়েন করা সেনাসদস্যদের কার্যক্রম পরিদর্শন ও প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দেন।
গতকাল ভোলায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় কোস্টগার্ডের কার্যক্রম পরিদর্শন করেন কোস্টগার্ড মহাপরিচালক রিয়ার অ্যাডমিরাল আশরাফুল হক চৌধুরী। পরে তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশনের নির্দেশনা অনুযায়ী একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের পরিবেশ সৃষ্টিতে কোস্টগার্ড তাদের দায়িত্ব পালনে সদা তৎপর রয়েছে।
কোস্টগার্ড সদর দপ্তরের মিডিয়া কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট কমান্ডার খন্দকার মুনিফ তকি জানান, নির্বাচনে অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি কোস্টগার্ড নির্বাচন-পূর্ববর্তী, নির্বাচনকালীন ও নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে স্থানীয় প্রশাসনকে সার্বিক সহায়তা দিতে মোবাইল টিম ও স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে দায়িত্ব পালন করছে। নির্বাচন কমিশনের নির্দেশনা অনুযায়ী কোস্টগার্ড উপকূলীয় ৪৩টি ইউনিয়নের সার্বিক শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য ২৯ ডিসেম্বর থেকে দায়িত্ব পালন শুরু করে। ১০ জানুয়ারি পর্যন্ত এ কার্যক্রম চলবে।
এর আগে গত বুধবার বিজিবি মহাপরিচালক মেজর জেনারেল এ কে এম নাজমুল হাসান শরীয়তপুর ও মাদারীপুর জেলায় বিজিবির নির্বাচনী বেজ ক্যাম্প পরিদর্শন করেন। তিনি বলেন, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে যে কোনো সহিংসতা ও নাশকতা রোধে সদা তৎপর রয়েছে বিজিবি। ভোটাররা যাতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভোটকেন্দ্রে আসতে পারেন, তার সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করতে এবং নির্বাচনকালীন দেশের সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বিজিবি সর্বোচ্চ পেশাদারিত্বের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছে। নির্বাচনকালীন যে কোনো ধরনের সহিংসতা ও নাশকতা রোধে বিজিবির প্রত্যেক সদস্য প্রস্তুত রয়েছে।
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন জানান, নির্বাচনে সমগ্র দেশের নিরাপত্তা পরিকল্পনার অংশ হিসেবে অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি র্যাব মোবাইল ও স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করছে। চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নিরাপদ পরিবেশ সৃষ্টির লক্ষ্যে র্যাব ফোর্সেস ২৯ ডিসেম্বর থেকে স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে প্রতিটি সংসদীয় আসনে মোতায়েন রয়েছে। এ ছাড়া ৩০টির বেশি অস্থায়ী ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছে।
র্যাব মুখপাত্র বলেন, জাতীয় নির্বাচন কেন্দ্র করে জনজীবন স্বাভাবিক রাখতে, জনগণের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় সম্পদ সুরক্ষা করতে র্যাব পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়েছে। জাতীয় নির্বাচন কেন্দ্র করে যে কোনো ধরনের নাশকতা কিংবা সহিংসতা প্রতিরোধে দেশব্যাপী ৭০০টির বেশি টহল দল আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় দায়িত্ব পালন করছে। এ ছাড়া এবারই প্রথম কোনো নির্বাচনে অপরাধী শনাক্তে ওআইভিএস ডিভাইস নিয়ে মাঠে নেমেছে র্যাব।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সূত্রগুলো বলছে, প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের কর্মী-সমর্থকদের হানাহানি বন্ধের পাশাপাশি এবারের নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে বাড়তি দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে। একটি পক্ষ ভোটে বাধা দেওয়ার ঘোষণা দিয়ে নানা ধরনের অপতৎপরতা চালাচ্ছে। ওই পক্ষটি যাতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটাতে না পারে, তাও দেখতে হচ্ছে পুলিশ ও র্যাব সদস্যদের। সে অনুযায়ী নিরাপত্তা পরিকল্পনাও করা হয়েছে। গোয়েন্দা সংস্থাগুলো তৎপর রয়েছে।