দেশের নির্বাচন ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গেছে। অতীতে একমাত্র তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই সুষ্ঠু নির্বাচন হয়েছে। এজন্য সেই ব্যবস্থা আবার ফিরিয়ে আনতে হবে। গতকাল সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) উদ্যোগে আয়োজিত ‘আসন্ন সিটি করপোরেশন নির্বাচন: প্রাসঙ্গিক ভাবনা’ শীর্ষক এক ভার্চ্যুয়াল বৈঠকে বক্তারা এসব কথা বলেন। তারা আরও বলেন, ভোটাররা এখন ভোট দিতে অনাগ্রহী হয়ে পড়েছে, দলের সমর্থকরাও ভোট দিতে যাচ্ছে না। নির্বাচন কমিশন প্রতিষ্ঠিতই হয়েছে ভোটাররা যাতে নির্বিঘ্নে কেন্দ্রে এসে ভোট দিয়ে আবার নির্বিঘ্নে বাড়ি ফিরে যেতে পারেন। কিন্তু নির্বাচন কমিশন সেটি করতে ব্যর্থ হচ্ছে।
সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, এই পাঁচ নির্বাচনের মাধ্যমে কিছুটা অন্তত স্পষ্ট হবে আমরা কোনদিকে যাচ্ছি। ২০১৩ অনুষ্ঠিত নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছিল। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি। ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত সিটি নির্বাচনগুলো সুষ্ঠু হয়নি।
এরপর অনুষ্ঠিত একাদশ সংসদ নির্বাচনও সুষ্ঠু হয়নি। এবার পরিস্থিতি ভিন্ন। গত নির্বাচনে বিরোধী দল অংশ নিয়েছিল। এবার ভোটারদের সামনে কোনো বিকল্প থাকবে না। বিরোধী দল অংশ না নেয়ায় এবারের নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক ও গ্রহণযোগ্য হবে না। আমাদের সাংবিধানিক বিধান হলো নির্বাচন হলো সুষ্ঠু ও প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচন তা না হলে সাংবিধানিক মানদণ্ড পূরণ হবে না। অতীতে দেখা গিয়েছে, সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যদি হস্তক্ষেপ না করে তাহলে সুষ্ঠু নির্বাচন হয়।
ড. এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, নির্বাচন কমিশন প্রতিষ্ঠিতই হয়েছে ভোটাররা যাতে নির্বিঘ্নে কেন্দ্রে এসে ভোট দিয়ে নির্বিঘ্নে বাড়ি ফিরে যেতে পারেন। নির্বাচন কমিশন এখন সেটি করতে ব্যর্থ হচ্ছে। আমাদের দেশে সবকিছু অনুকরণ করি। ভারতের অনুসরণে এখানে ভোটার দিবস করা হচ্ছে। ভোটার দিবস করতে হলে ভোটারদের কাছে যেতে হবে। ভোটাররা এখন ভোট দিতে অনাগ্রহী হয়ে পড়েছে, দলের সমর্থকরাও ভোট দিতে যাচ্ছে না। এই পাঁচ সিটির নির্বাচন দিয়ে সক্ষমতা বোঝা যাবে না। কারণ একপাক্ষিক নির্বাচন হচ্ছে।
এম হাফিজউদ্দিন খান বলেন, নির্বাচন ব্যবস্থা স¤পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গেছে। এটি ফিরিয়ে আনার জন্য যে মনোভাব দরকার তা কারও মধ্যে দেখা যাচ্ছে না। কেউ চায় না সুষ্ঠু নির্বাচন হোক। ইতিহাস থেকে আমরা দেখেছি, একমাত্র তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন হয়েছে। তাই সেই ব্যবস্থা আবার ফিরিয়ে আনতে হবে।
সাবেক সচিব আবু আলম শহীদ খান বলেন, কয়েকটি দল অংশ না নেয়ায় এই নির্বাচন নিয়ে একটি বড় অংশের উৎসাহ থাকবে না। তারপরও যারা অংশ নিচ্ছে তারা যাতে সমান সুযোগ পান, সে ব্যাপারে সংশ্লিষ্টদের সচেষ্ট হতে হবে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে এখন পর্যন্ত নির্বাচন কমিশন ও ক্ষমতাসীনরা সবার জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হচ্ছেন।
ড. তোফায়েল আহমেদ বলেন, বাংলাদেশে এখন নির্বাচন যে অবস্থায় আছে তাতে এই নির্বাচনগুলো বুদ্ধিবৃত্তিক পর্যবেক্ষণের দিক থেকে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে। এখন নির্বাচনে যত কম দল অংশ নিচ্ছে, যত কম মানুষ ভোট দিচ্ছে তত বেশি ক্ষমতাসীনদের জন্য সুবিধা হচ্ছে। নির্বাচনে প্রতিযোগিতা থাকলে ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়। এখন নিজেদের মধ্যে ঝুঁকিমুক্ত নির্বাচনের একটি ধারা দাঁড়িয়ে গেছে।
অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, প্রথমত আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে হওয়া নির্বাচনগুলোতে প্রকাশ্যে ব্যাপক কারচুপি হবে, অনিয়ম হবে, প্রতিপক্ষের উপর হামলা হবে। আর এই সমস্ত কাজে পুলিশ এবং প্রশাসন প্রকাশ্যে ন্যক্কারজনক অবস্থান নিবে। এই ট্রেন্ড থেকে আমরা যে সিদ্ধান্তে আসতে পারি সেটি হচ্ছে বর্তমান সরকারের সুষ্ঠু নির্বাচন করার কোনো উদ্দেশ্য কিংবা দক্ষতা কোনোটাই নাই। দ্বিতীয়ত এই সরকার প্রশাসন, পুলিশ এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিচারবিভাগকে এমনভাবে দলীয়করণ করেছে যে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোরও এই সরকার ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় সুষ্ঠু নির্বাচনে ভূমিকা রাখার কোনো অবকাশ নাই। তৃতীয়ত এই সরকারের এবিলিটি এবং ইনটেনশনের এই প্রকট অবস্থানের কারণে নির্বাচন ব্যবস্থার প্রতি মানুষের আগ্রহ কমেছে। নির্বাচনী সংস্কৃতি ধ্বংস করা হয়েছে। সুষ্ঠু নির্বাচন ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনতে হলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ছাড়া কোনো বিকল্প নাই। এর বাইরে তারা যদি অন্য চিন্তা করতে চান তাহলে সর্বদলীয় সরকারের চিন্তা করা যায়। নির্বাচন কমিশনকে হুমকি দিয়ে আইন প্রণয়নে বাধ্য করিয়ে কোনো লাভ হবে না।
রোবায়েত ফেরদৌস বলেন, একের পর এক বিতর্কিত নির্বাচন করার মধ্যদিয়ে নির্বাচন ব্যবস্থার কেন্দ্রীয় নায়ক ভোটারদেরকে অপমান করা হচ্ছে। ভোটাররা ভোটের দিন ক্ষমতায়িত বোধ করেন, সেটি আবার কবে ফিরে পাবো সেটিই আমাদের এখন মূল প্রশ্ন।
লিখিত প্রবন্ধে দিলীপ কুমার সরকার বলেন, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে অনুষ্ঠেয় এ পাঁচটি সিটি করপোরেশন নির্বাচন কেমন হবে, তা নিয়ে জনমনে নানা প্রশ্ন রয়েছে। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলসহ বেশ কিছু রাজনৈতিক দল এই নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে না। ফলে সব দলের অংশগ্রহণে একটি প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচনের যে প্রত্যাশা, তা পূরণ হচ্ছে না। তারপরেও মানুষের আকাক্সক্ষা এই নির্বাচন অবাধ, নিরপেক্ষ, শান্তিপূর্ণ তথা সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠিত হোক। ২০১৮ সালের ৩০শে ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কয়েক মাস পূর্বে এই ৫টি সিটি করপোরেশনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। পাঁচ সিটির পূর্বের এই নির্বাচন নিয়ে অনেক অভিযোগ ও প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছিল। পাঁচটি সিটি নির্বাচনকেই ‘নিয়ন্ত্রণ’ করার এক ধরনের প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা গিয়েছিল।