বিএনপিসহ কিছু রাজনৈতিক দল বলছে, আওয়ামী লীগের অধীনে তারা কোনো নির্বাচনে যাবে না। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ ও তাদের মিত্রদের ভাষ্যÑ সংবিধানের বাইরে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এমন সংকট থেকে উত্তরণে বড় দলগুলোর মধ্যে আলোচনা চাচ্ছেন কূটনীতিকরা। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা অনেক রাষ্ট্র বাংলাদেশে একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নিয়ে তৎপরতা শুরু করেছে।
যুক্তরাষ্ট্র স্পষ্ট করেছেÑ বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ তৈরিতে সরকার, বিরোধী দল ও নাগরিক সমাজের সবার প্রচেষ্টায় তারা অংশীদার হতে চায়। এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপেও ভূমিকা রাখতে চায় তারা। অন্যদিকে গত সোমবার বাংলাদেশে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিতের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র তার অবস্থানে অবিচল রয়েছে বলে হোয়াইট হাউসের এক সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন দেশটির জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের (এনএসসি) স্ট্র্যাটেজিক কমিউনিকেশন পরিচালক অ্যাডমিরাল জন কিরবি।
২৪ মে মার্কিন ভিসানীতি ঘোষণার পর থেকে রাষ্ট্রদূত দূত পিটার হাস স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আবদুল মোমেন, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও বিরোধীদলীয় উপনেতা জিএম কাদের এবং প্রধানমন্ত্রী মুখ্য সচিব তোফাজ্জল হোসেন মিয়ার সঙ্গে বৈঠক করেন। তারও আগে তিনি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ, সংসদের বাইরে থাকা বিরোধী দল বিএনপি এবং সংসদের প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টির প্রতিনিধিদের নিয়ে এক টেবিলে বসে মতবিনিময় করেন।
সম্প্রতি পিটার হাস প্রায় প্রতিদিন বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করছেন; জানতে চাচ্ছেন আগামী নির্বাচন নিয়ে তাদের ভাবনা।
গতকাল মঙ্গলবার সবচেয়ে ব্যস্ত দিন পার করেন পিটার হাস। দুপুরে বৈঠক করেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সঙ্গে। এর আগে সকালে প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও
বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান এবং আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠকগুলোতে আগামী জাতীয় নির্বাচন নিয়ে কথা হয়েছে বলে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে।
পিটার হাসের আমন্ত্রণে তার বাসায় বৈঠকে যান বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। সোয়া ঘণ্টাব্যাপী আলোচনার প্রায় পুরোটাই ছিল আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে।
সূত্র জানায়, মির্জা ফখরুল পিটার হাসকে বলেন, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয় বলে মনে করে বিএনপি। ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচন এবং দেশের বর্তমান রাজনৈতিক চিত্র তুলে ধরার পর ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনে আর কোনো নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না বলেও স্পষ্ট করা হয়। মির্জা ফখরুল বলেন, মার্কিন রাষ্ট্রদূতের আমন্ত্রণে তিনি সেখানে গিয়েছিলেন এবং সেখানে প্রায় এক ঘণ্টা অবস্থান করেন। তারা বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি, আগামী নির্বাচন এবং বাংলাদেশের ওপর মার্কিন ভিসা বিধিনিষেধ নিয়ে আলোচনা করেন। আলাপকালে বিএনপি নেতা বলেন, আগামী নির্বাচন নিয়ে দলের অবস্থান খুবই স্পষ্ট এবং বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি বর্ণনা করেই তা আবারও জানানো হয়েছে।
অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান এবং আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের সঙ্গে বৈঠক করেন ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস। গতকাল সকালে প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টার গুলশানের অফিসে এই বৈঠক হয়। বৈঠকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উত্তর আমেরিকা অনুবিভাগের মহাপরিচালক খন্দকার মাসুদুল আলম এবং ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাসের পলিটিক্যাল অ্যান্ড ইকোনমিক কাউন্সেলর স্কট ব্রেনডন উপস্থিত ছিলেন।
কূটনৈতিক সূত্র জানিয়েছে, ওই বৈঠকে রাজনীতি, অর্থনীতি, মানবাধিকারসহ বাংলাদেশের সমসাময়িক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়েছে; কথা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের বাংলাদেশবিষয়ক নতুন ভিসানীতি নিয়েও। বাংলাদেশের শ্রম আইনের সংশোধন-সংযোজন এবং পরিমার্জনের বিষয়টিও আলোচনায় এসেছে। বাংলাদেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, মানবাধিকার পরিস্থিতি; বিশেষ করে আগামী নির্বাচন এবং বিদ্যমান শ্রম আইন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের গভীর উদ্বেগ রয়েছে।
গত রবিবার জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও জাতীয় সংসদের বিরোধী দলীয় উপনেতা জিএম কাদেরের সঙ্গে বৈঠক করেন পিটার হাস। মার্কিন রাষ্ট্রদূতের বাসায় এ বৈঠক হয়। একটি সূত্র জানিয়েছে, আগামী জাতীয় নির্বাচনে জাতীয় পার্টির অবস্থান কেমন হবেÑ বৈঠকে তা জানতে চান মার্কিন রাষ্ট্রদূত। জাতীয় পার্টি কোনো জোটে যাবে কিনা, সে জিজ্ঞাসাও ছিল পিটার হাসের।
আগামী ৮ জুলাই ১৩ দিনের মিশনে ঢাকায় আসবে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের (ইইউ) নির্বাচনপূর্ব পর্যবেক্ষক দল। বাংলাদেশের নির্বাচনী পরিবেশ ও গতিবিধি পর্যবেক্ষণের পাশাপাশি রাজনৈতিক দল ও সুশীল সমাজসহ বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে তাদের বসার কথা রয়েছে। জানা গেছে, তাদের প্রতিবেদনের ভিত্তিতেই ইইউ সিদ্ধান্ত নেবে, তারা আগামী নির্বাচনে পর্যবক্ষেক পাঠাবে কিনা।
অন্যদিকে বাংলাদেশের ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ডেলিগেশন প্রধান চার্লস হোয়াইটলি রাজনৈতিক সংকট কাটাতে আলোচনাকেই যে গুরুত্ব দিচ্ছেন, তা স্পষ্ট করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘আমার বিশ্বাস, রাজনৈতিক দলগুলো জানে, নির্বাচনে তাদের অংশগ্রহণের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। কোন দল অংশ নেবে, তা একান্তই তাদের পছন্দের বিষয়। তবে পরস্পরের প্রতি যদি কোনো অবিশ্বাস থাকে, তবে সংলাপে বসা যেতে পারে।’ ইইউর ঢাকা প্রধান বলেন, জাতীয় নির্বাচনে সাধারণ মানুষের মতামত প্রতিফলিত হবে বলেই প্রত্যাশা তাদের।
এদিকে গতকাল আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ও ১৪ দলের সমন্বয়ক আমির হোসেন আমু জানিয়েছেন, জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় বিএনপির সঙ্গে বৈঠক হতে পারে। তিনি বলেন, সংবিধানের মধ্যে থেকে গণতন্ত্রের ধারা অব্যাহত রাখতে বিএনপিসহ সকল রাজনৈতিক দলের জন্য আলোচনার দরজা সবসময় খোলা।