সোমবার, ১৪ই অক্টোবর, ২০২৪

সর্বশেষ

ডেঙ্গু আক্রান্তের এক-চতুর্থাংশই শিশু

পূর্ব গোড়ানের বাসিন্দা কবিরুল আলম ও রুবিনা ইয়াসমিন দম্পতির আড়াই বছরের মেয়ে রুফাইদা। ঈদের আনন্দ কাটতে না কাটতেই এই পরিবারে নেমে আসে দুশ্চিন্তা। ঈদের পর দিন থেকেই জ্বরে ভুগছিল রুফাইদা। সঙ্গে পেট খারাপ, পেট ব্যথাও। নাপা সিরাপ খাইয়ে সাময়িকভাবে জ্বর কমে। এরপর আবার আসে। ৪ দিন আগে জানা গেল, রুফাইদা ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত। কোনো ঝুঁকি না নিয়ে তাকে ভর্তি করানো হয় রাজধানীর মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। গতকাল শনিবার দেখা গেল, একটু পরপরই জ্বরের তীব্রতায় ছটফট করছে রুফাইদা। কেঁদে কেঁদে বলছে ‘ব্যথা, ব্যথা।’ মেয়ের ব্যথা কমাতে নানা চেষ্টা করছিলেন রুবিনা। কিন্তু তাতে খুব একটা কাজ হয়নি। কান্না সাময়িক থামলেও একটু পর আবার রুফাইদার কান্না শুরু হয়। সন্তানের এই কষ্টে চোখ ভিজে উঠছিল রুবিনারও।

মুগদা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, প্রতিনিয়তই শিশুদের নিয়ে অভিভাবকরা হাসপাতালে আসছেন। অর্ধেকের মতো শিশুকে ভর্তি করতে পারছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। আর হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের প্রায় এক-চতুর্থাংশই শিশু। এদের মধ্যে ছয় মাসের শিশুও রয়েছে।

হাসপাতালের পুরুষ ওয়ার্ডের চিত্রটিও একই রকম। প্রতিটা বেডেই রোগী। ১০ তলায় পুরুষ ওয়ার্ডে ভর্তি খিলগাঁও এলাকার বাসিন্দা ইব্রাহিম (৩৭)। ৫ দিন হলো হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন তিনি। তার পাশে বিষন্ন হয়ে বসে ছিলেন স্ত্রী ফরিদা পারভীন। একটু পরপর ক্যানুলা লাগানো স্বামীর ডান হাতটায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলেন। তার এমন উদ্বেগের কারণ, হাসপাতালে ভর্তির পর বৃহস্পতিবার হঠাৎ করেই ইব্রাহিমের রক্তে প্লাটিলেট কমে গিয়েছিল। চিকিৎসা চললেও দুশ্চিন্তা কাটছে না। ফরিদা বলেন, ডাক্তার বলেছে ওর (ইব্রাহিম) অবস্থা এখন ভালো। কিন্তু ভরসা পাচ্ছি না। বাসায় ৭ বছর ও ৩ বছর বয়সি দুইটা বাচ্চা, বয়স্ক শাশুড়ি। ওকে নিয়ে হাসপাতালে আছি। ওদের জন্যও চিন্তা হয়। কবে বাসায় যাব তা-ও জানি না। বাসায় গিয়ে সবাই কতদিন পর্যন্ত সুস্থ থাকতে পারব এর-ও-তো নিশ্চয়তা নেই।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের ৫৫টি ওয়ার্ডে এডিস মশার লার্ভার উপস্থিতি ছিল অধিক ঝুঁকিপূর্ণ। তবে পুরো ঢাকার সবাই এই ঝুঁকিতে আছে। হাসপাতালের ৩য় তলায় মহিলা ওয়ার্ডে ভর্তি ছিলেন ইশরাত (২৯)। গতকাল শনিবার হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র পেয়েছেন তিনি। ছাড়পত্র পেয়ে বাড়ি যাওয়ার খুশির পাশাপাশি আতঙ্কিতও ছিলেন ইশরাত। ইশরাত বলেন, পত্র-পত্রিকায়, খবরেতো দেখছি, এ বছর নাকি ডেঙ্গুর ব্যাপকতা আগের চেয়ে আরো বাড়বে। সুস্থ হয়ে বাসায় যাচ্ছি ঠিকই; কিন্তু কতক্ষণ সুস্থ থাকতে পারব জানি না। রবিবার থেকে স্কুল খুলছে। আমার দুটি ছেলে মতিঝিল আইডিয়াল স্কুলে পড়ে। বাসায় আমরা যতই সচেতন থাকি, স্কুলে বা গাড়িতে কি বাচ্চারা নিরাপদ? আমরা নিরাপদ?

পবিত্র ঈদুল আজহার ছুটি কাটিয়ে আজ রবিবার খুলছে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। রাজধানীসহ সারাদেশে ডেঙ্গুর ব্যাপকতা বেড়ে যাওয়ায় ইশরাতের মতো অনেক অভিভাবকই সন্তানদের নিরাপত্তা ও সুস্থতা নিয়ে উদ্বিগ্ন। কারণ ঈদুল আজহার কারণে দীর্ঘদিন বন্ধ ছিল স্কুল। এর মধ্যে গত কয়েকদিন টানা বৃষ্টি হয়েছে। সুতরাং এবার স্কুলগুলোতে এডিস মশার বিস্তার ঘটতে পারে। তবে এ বিষয়ে কর্তৃপক্ষ বলছে, বিষয়গুলো নিয়ে তারা সচেতন আছে। প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে।

গতকাল শনিবার মুগদা হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, হাসপাতালের বিভিন্ন ওয়ার্ডের বেডে যেমন রোগীতে পূর্ণ; তেমনি সিঁড়ি-লিফটেও রোগীদের স্বজনের ভিড়। দায়িত্বরত নার্সরাও ছুটছেন এক বেড থেকে অন্য বেডে। তবে অনেক ডেঙ্গুরোগীকে দেখা গেছে মশারি ছাড়াই শুয়ে থাকতে। মশারি না টাঙানোর পক্ষে তাদের যুক্তি ‘অনেক গরম’। অথচ চিকিৎসকরা বলছেন, ডেঙ্গু আক্রান্তদের অবশ্যই মশারি ব্যবহার করতে হবে। কারণ, ডেঙ্গু আক্রান্ত কোনো ব্যক্তিকে একটি এডিস মশা কামড় দিয়ে যদি ওই মশা সুস্থ কাউকে কামড় দেয় তাহলে তারও ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। দায়িত্বরত নার্সরা জানান, শুরু থেকেই এই হাসপাতালে ডেঙ্গুরোগী বেশি। দিন দিন রোগী বাড়ছে। যে সংখ্যক রোগী ভর্তি থাকছে, সে অনুযায়ী নার্সসহ অন্যান্য সুযোগ সুবিধা এখানে নেই।

প্রতিদিন রোগীর চাপ বাড়া এবং রোগীদের চিকিৎসা দেয়ার জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক ডাক্তার ও নার্স সংকটের কথা স্বীকার করলেন হাসপাতালটির পরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. নিয়াতুজ্জামানও। তিনি বলেন, প্রতিদিনই ডেঙ্গু আক্রান্ত ভর্তি রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। তাদের পাশাপাশি হাসপাতালে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত রোগীদের সেবা দিতে হচ্ছে। আমরা সাধ্যমতো চেষ্টা করছি প্রতিটা রোগীর সেবা নিশ্চিত করতে। তবে যে হারে রোগী আসছে, এমনটা চলতে থাকলে চিকিৎসক-নার্সসহ অন্যান্য জনবলের প্রয়োজন হবে। না হলে সেবা চালিয়ে যাওয়া কষ্টসাধ্য হয়ে পড়বে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, সরকারি হাসপাতালগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি রোগী মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। গত ২৪ ঘণ্টায় এই হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ১২৭ জন রোগী। আর হাসপাতালে ভর্তি আছে ৩৪৭ ডেঙ্গুরোগী। এরপরই বেশি রোগী ভর্তি আছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে। সেখানে ২৪ ঘণ্টায় ৫৮ জন আর ভর্তি রোগীর মোট সংখ্যা ২২৪ জন। মিটফোর্ড হাসপাতালে ২৪ ঘণ্টায় ১০৯ জন আর ভর্তি রোগীর সংখ্যা ১৭০ জন। শিশু হাসপাতালে ২৪ ঘণ্টায় ১২ জন এবং মোট ৩৮ জন শিশু ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ভর্তি আছে।

এদিকে ঢামেক হাসপাতালেও ডেঙ্গুরোগী বাড়ছে। সেখানেও বেড না পেয়ে রোগীরা মেঝেতে থাকছেন। তবে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি শিশুদের বিষয়টি নিয়ে শঙ্কিত চিকিৎসকরা। গত ১৫ দিনে ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ৭০ জন শিশু। ঢামেক হাসপাতালের শিশু বিভাগের অধ্যাপক ডা. ইফফাত আরা শামসাদ ভোরের কাগজকে বলেন, গুরুতর ডেঙ্গু নিয়ে দৈনিকই ৫ থেকে ৬ জন শিশু এখানে ভর্তি হচ্ছে। গত ১৫ দিনে প্রায় ৭০ জন শিশু এখানে ভর্তি হয়েছে। ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশুদের মধ্যে এ বছর সাধারণ উপসর্গের পাশাপাশি কিছু নতুন উপসর্গও দেখা যাচ্ছে। ডেঙ্গু আক্রান্ত হলে অনেকেরই জ্বরের সঙ্গে ডায়রিয়া ও বমির সমস্যা হচ্ছে। এছাড়া মাথা ব্যথা, গায়ে ব্যথাও থাকছে। খুব তাড়াতাড়ি শকে চলে যাওয়ার প্রবণতাও লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বিষয়গুলো সত্যিই উদ্বেগের। সরকারের উদ্যোগের পাশাপাশি নিজেদের সচেতনতাও দরকার। শুধু শিশু নয়; বড়রাও যখনই জ্বরে আক্রান্ত হবেন কিংবা পেট খারাপসহ অন্য উপসর্গগুলো দেখা দেবে আমি বলব তারা যেন দ্রুতই চিকিৎসকের পরামর্শ নেন।

ডেঙ্গু পরিস্থিতি যে উদ্বেগজনক অবস্থায় যাচ্ছে তা নিয়ে বহুবারই উদ্বেগ প্রকাশ করেছে স্বাস্থ্য বিভাগ। পরিস্থিতি আন্দাজ করে হাসপাতাল প্রস্তুত এবং গাইডলাইন মেনে চিকিৎসার নির্দেশ অনেক আগেই দেয়া হয়েছে। একাধিকবার নিজেদের প্রস্তুতির কথা জানিয়ে মশা নিয়ন্ত্রণে সংশ্লিষ্ট বিভাগকে আরো বেশি তৎপর হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক। পরিস্থিতির ভয়াবহতার আভাস পেয়ে দেরিতে হলেও মশা নিয়ন্ত্রণে তৎপর হয়েছে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন।

আরও পড়ুন